ইসলামের মূল পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম পবিত্র হজ্জ। হজ্জ সামর্থবানদের প্রতি আল্লাহ তাআলার বিশেষ বিধান। হজ্জ পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার অনেক নিকটে চলে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হজ্জে মাবরূরের পুরস্কার একমাত্র জান্নাত। সৎ উদ্দেশ্যে যারা হজ্জ পালন করবেন, আল্লাহ পাক তাদের হজ্জ কবুল করবেন এবং তাদের জন্য থাকবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। চলছে পবিত্র জিলহজ্ব মাস। এবছর আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ হজ্জ পালন করেছেন। তারা কতই না সৌভাগ্যবান যাদের এই হজ্জের পিছনে জাগতিক কোন উদ্দেশ্য ছিল না। যারা বাইতুল্লাহ যিয়ারত করেছেন একমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য, আল্লাহকে পাবার জন্য। তাদের হজ্জ মাকবূল ও মাবরূর। হজ্জের ফযীলত সম্পর্কীত কয়েকটি সহীহ হাদীসঃ ১) হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হজ্জ করবে এবং সর্বপ্রকার অশ্লীল কথা ও কাজ ও পাপাচার থেকে বিরত থাকবে, সে হজ্জ থেকে ফিরে আসবে (পাপমুক্ত হয়ে) ঐদিনের মত যেদিন সে মাতৃগর্ভ হতে ভ‚মিষ্ট হয়েছে। সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১১৩৭ ২) হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি ইমান রাখা। জিজ্ঞাসা করা হলো-তারপর কি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলো- এরপর কি? তিনি বললেন, হজ্জে মাবরূর। সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১১৩৬ ৩) হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একটি উমরা পরবর্তী উমরা পর্যন্ত এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল পাপের কাফফারা হয়ে যায়। আর মাবরূর হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া কিছুই হতে পারে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৩৩৫৫ ৪) হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা হজ্জকে উমরা এবং উমরাকে হজ্জের অনুগামী করো। (অর্থাৎ যথাসম্ভব বারবার হজ্জ উমরা করো) কারণ হজ্জ ও উমরা দারীদ্রতা এইরূপ দূরীভ‚ত করে যেরূপ কামারের হাপর লোহার জং পরিস্কার করে। সুনানে নাসাঈ, হাদীস নং-২৬৩০ উপরোক্ত হাদীসগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য হাদীসে হজ্জের বিভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। হজ্জের ফযীলত সম্পর্কীত এসব হাদীসগুলো কমবেশি আমরা সবাই জানি। কুরআনুল কারীমের আয়াত এবং ফযীলত সংক্রান্ত সবগুলো হাদীস একত্রিত করলে হজ্জ মাকবূল ও মাবরূর হওয়ার জন্য মৌলিক একটি শর্ত পাওয়া যায়। তা হলো হজ্জটি পাপমুক্ত হওয়া। কেউ যদি কথা-কাজ, আচার-আচরণ সবকিছুতে গুনাহমুক্ত থেকে হজ্জ পালন করতে পারেন তাহলে তার পুরস্কার হলো, সে সদ্যজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে হজ্জ থেকে ফিরে আসে। আল্লাহ তাআলার সুবিশাল এই ক্ষমা ও মাগফিরাত পাওয়ার দাবি হলো- হাজী সাহেব হজ্জ পালনরত অবস্থায় যেরূপ পাপমুক্ত থেকেছেন, হজ্জের পরেও বাকী জীবন পাপমুক্ত জীবন যাপনে অভ্যস্থ হবেন। কোন অবস্থাতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাফরমানি করবেন না। তাহলেই এই মহা পুরস্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। পাপমুক্ত জীবন মানে কি? প্রশ্নটি বুঝার আগে জানতে হবে পাপ কাকে বলে। ছোট্ট করে বললে পাপ বলা হয়, ইসলামের অবশ্য পালনীয় কোন বিধান লঙ্ঘন করা। তাই ইসলামের বিধি-বিধানের ফিরিস্তি যত লম্বা পাপের ব্যাপ্তিও তত বিস্তৃত। কারণ ইসলাম হচ্ছে সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। নিছক আচার-অনুষ্ঠানের নাম নয়। ইসলামে মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য বিধি-নিষেধ রয়েছে। ইসলামী জীবন বিধানের মৌলিক ক্ষেত্র পাঁচটি। যথা : এক. আকাইদ (বিশ্বাষ পরিশুদ্ধ করা) দুই. ইবাদাত (উপাসনা) তিন. মুআমালা (পারস্পরিক লেনদেন) চার. মুআশারা (পারস্পরিক আচার-আচরণ) পাঁচ. আখলাক (স্বভাব-চরিত্র) ইত্যাদি। এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই রয়েছে আল্লাহ পাকের নির্ধারিত বিধান এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ। এরই নাম দ্বীন ও শরীয়ত। এর অনুসরণ করাই ছাওয়াব-পূণ্য আর লঙ্ঘন করার নাম পাপ-গুনাহ। অতএব পূন্যময়- পাপমুক্ত জীবন যাপনের অর্থ হলো, জীবনে সম্মুখিন হওয়া সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মানা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করা। আল্লাহ তাআলা যাদের হজ্জ পালন করার তাওফীক দান করেছেন তারা কতই না সৌভাগ্যবান। তারা বাইতুল্লাহ শরীফ স্বচক্ষে দেখেছেন, তাওয়াফ করেছেন, নবীজির রওযায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছেন, দুরূদ-সালাম পেশ করেছেন, তাদের তো এই প্রেরণা নিশ্চয়ই জাগ্রত হয়েছেই যে, আগামী জীবনে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মানবে। কোন অবস্থাতেই সুন্নাহ পরিপন্থি কাজ করবে না। যত কষ্টই হোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিবে না। এখন যদি এই প্রেরণার সাথে সহীহ নিয়ত ও সৎসাহস যুক্ত করে বাকী জীবনের জন্য এই প্রতিজ্ঞা করা যায় যে, “আল্লাহ রাব্বুল ইয্যত আমাকে মেহেরবানী করে পাপমুক্ত পবিত্র জীবন দান করেছেন, কখনই আমি এতে কালি লাগতে দিব না” তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সাহায্য-নুসরতও হতে থাকবে। কারণ এরকম কখনই হতে পারে না যে, বান্দা পাপমুক্ত জীবন যাপন করতে চাচ্ছে আর আল্লাহ সাহায্য করছেন না। হাদীসে কুদসীতে পরিস্কার বলা আছে, বান্দা ভাল কাজে এক বিঘত অগ্রসর হলে আল্লাহ তাআলার সাহায্য দ্বিগুন আসে। (সহীহ বুখারী) এই মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন, “যারা আমার পথে (চলার জন্য) মুজাহাদা- চেষ্টা করে, অবশ্যই আমি তাদের পথ প্রদর্শন করি (সাহায্য করি)”। সূরা আনকাবুত, আয়াত নং-৬৯ হজ্ব অনেকেই করে। কবুল কয়জনের হয়? কবুল করার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তাআলা। তবে কাদের হজ্ব কবুল হয়েছে, এব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বাহ্যিক কিছু নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। সবচে বড় আলামত হলো, হজ্বেও পর সে আর গুনাহ করে না, বরং কথা, কাজ, আমল, আখলাক ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে আল্লাহ তাআলার বিধান ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক চলতে চেষ্টা করে। এক কথায় দ্বীন পালন ও নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে সে সকল কাজে অগ্যগন্য থাকবে। কারণ হজ্ব করা বড় কথা নয়। হজ্বটা ধরে রাখতে পারাই মূল সফলতা ও সার্থকতা। সুতরাং প্রত্যেকটি হাজ্বী সাহেবগণের জন্য কর্তব্য হলোঃ ১) নিজের আকীদা-বিশ্বাসকে দুরস্ত করা। পূর্বে শয়তানের ধোকায় কোন ধরণের শিরকি-বিদআতি কাজের সাথে যুক্ত থাকলেও এখন থেকে এসব পরিপূর্ণরূপে মুক্ত থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। ২) ইবাদত-বন্দেগীর ব্যাপারে পূর্বের চেয়ে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া। ফরয ইবাদতগুলো তো পালন করবেই। ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুয়াক্কাদার পাশাপাশি যথাসম্ভব নফল ইবাদত বাড়ানোর চেষ্টা করা। ৩) লেনদেনের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা। কোনভাবেই যেন হারামে পতিত না হয়। কারণ রিযিকে হারাম ছাড়তে না পারলে দ্বীনদার হওয়া যায় না। ৪) আচার-ব্যবহার দুরস্ত করা। মানুষ তো বহু দূরের কথা, কোন প্রাণীও যেন কষ্ট না পায় এমনভাবে জীবন পরিচালনা করা। ৫) আখলাক-চরিত্র ঠিক করা। অর্থাৎ সকল প্রকার ভালগুণ যেমন বিনয়-ন¤্রতা, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সংযম, পরোপকার, অন্যের হীত কামনা ইত্যাদি অর্জন করা এবং যাবতীয় খারাপ গুণ যেমন অহংকার ক্রোধ, কৃপণতা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকা। কারণ একজন ভালো মুসলমান নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। বড়ই আফসোস! অনেক আল্লাহর বান্দা আছেন হজ্বের পরে হাজ্বী সাহেব না বললে চাল-বাড়ী মাথায় নিয়ে বসেন। আচার-আচরণে মনে হয়, মানুষ হাজ্বী সাহেব বলবে আলহাজ্ব লিখবে এজন্য হজ্ব করেছেন। শুনেছি, অনেকে হজ্ব করবে বলে গরু জবাই করে মানুষের কাছে ইলান করে। অথচ ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত ইখলাস। একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা। হে পরওয়ারদেগার! উম্মাতের হাজ্বী সাহেবদের হজ্বসহ কবরে যাওয়ার তাওফীক দান করুন। আমাদের সকলকে পাপমুক্ত জীবন গঠন করার তাওফীক দান করুন। আপনার ঘর তাওয়াফ করার সৌভাগ্য নসীব করুন। যারা হজ্ব করেছেন তাদের হজ্বকে মাবরূর হিসেবে গন্য করে নিন। আল্লাহুম্মা আমিন।